ইউরোপে ইতালির মত ল্যাটিন আমেরিকার এবারের আক্ষেপ চিলি। টানা দু’বারের কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন চিলির তারকা সমৃদ্ধ দলটির সাথে সাথে ফুটবলপ্রেমী সমর্থকদেরও দুর্ভাগ্য এবারের বাছাইপর্ব থেকেই ছিটকে যাওয়া। নাহলে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সাথে সাথে সম্ভাবনার নিরিখে ভিদাল-ব্রাভো-সানচেজের চিলিকেও প্রথম কাতারেই রাখা যেত।

একারণে ২০১৮-র বিশ্ববকাপে ল্যাটিনের পতাকা প্রধাণত থাকবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে আর কলম্বিয়ার হাতেই। আর পেরুর গ্রুপ পর্বের বাধা পার হয়ে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ডেই আর্জেন্টিনার সামনে পরার। তাই সবদিক বিবেচনা করে ঘুরে-ফিরে সেই চারটা দল নিয়েই আশায় থাকবে সারা দুনিয়া জুড়ে ল্যাটিনের সুন্দর ফুটবলের পূজারী কোটি কোটি সমর্থক।
প্রথমেই আসা যাক দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী কাভানি-সুয়ারেজের উরুগুয়ের কথায়। উরুগুয়ের আসল পরীক্ষা শুরু হবে গ্রুপ পর্ব থেকেই। স্বাগতিক রাশিয়া আর ফুটবল বিশ্বের নতুন সেনসেশন মোহাম্মদ সালাহ-র মিশরকে টপকে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলে তাদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে স্পেন অথবা পর্তুগালের। এরপরের প্রতিপক্ষ হতে পারে ফ্রান্স; সুতরাং উরুগুয়ের এবারের বিশ্বকাপ দৌড় কতদূর গিয়ে থামবে সেটাকে সময়ের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভাল।

গ্রুপ ভাগ্য আর সামর্থ্যের মিশেলে চমক দেখানোর সম্ভাবনা রয়েছে কলম্বিয়ার। কিন্তু সেখানেও প্রথমে তাদের গ্রুপ পর্ব থেকে পোল্যান্ড, আফ্রিকান ঈগল সেনেগাল আর এশিয়ার ব্রাজিল জাপানকে পার হতে হবে। পরের রাউন্ডে যেতে পারলে সামনে থাকবে ইংল্যান্ড অথবা বেলজিয়ামের মত প্রায় সমশক্তির দল। সামর্থ্য বিবেচনায় কলম্বিয়ার পক্ষে অন্তত কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব।
তারপর তাদের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে প্রতিবেশী ব্রাজিলের। বাকি সমীকরণটা না হয় ভবিষ্যতের উপর রেখে দেওয়া যাক।
এবার আসা যাক বিগত প্রায় এক দশক ধরে ফুটবলের যুবরাজ, মতান্তরে ভাগ্যহারা এক নিঃসঙ্গ রাজপুত্র লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার সম্ভানায়। গত বিশ্বকাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আর্জেন্টিনা ২০১৪-তে ব্রাজিলে গিয়েছিল সেসময়ের সবথেকে শক্তিশালী এবং ভয়ঙ্কর স্ট্রাইকারদের নিয়ে। শেষে দেখা গেল, দলটার ঐতিহ্যবাহী ভঙ্গুর ডিফেন্স আর সবেধন নীলমণি এক মেসির বদৌলতেই তারা পৌঁছে গেলো ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দীর্ঘদিনের শিরোপাস্বপ্ন সত্যি না হওয়ার পিছে যতটা না সেদিন মেসির নিষ্প্রভতা দায়ী তার থেকে বেশি দায়ভার বহন করতে হবে তাদের তথাকথিত ক্লাব লিজেন্ড স্ট্রাইকারদেরই।
এবারের বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনা কেবলই মেসির আর্জেন্টিনা। আর সাথে যদি গতবারের মত তাদের ডিফেন্স না দাঁড়ায় তাহলে স্বপ্নের যে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফাইনাল প্রতিটি বিশ্বকাপের আগে অগণিত ভক্তরা আশা করে আসে- সেটা স্বপ্নই থেকে যাবে। ফিক্সচার অনুযায়ী এবার একটা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ফাইনাল সম্ভব, তবে সেক্ষেত্রে ব্রাজিলকে যেমন সমীকরণ মেলাতে হবে, তেমনি আর্জেন্টিনাকে পার করতে হতে পারে পর্তুগাল/স্পেন এবং ফ্রান্সের মত কঠিন বাঁধাকে। রাশিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়াও দাঁড়াতে পারে আর্জেন্টিনার বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে।

ফুটবলের ইতিহাসে সফলতম দলটি ব্রাজিল। এমনকি এবারেও সবচেয়ে সম্ভানাময় দলটি ওই সেলেসাওরাই। অমিত প্রতিভাবান এবং আক্ষরিক অর্থেই সবথেকে দামী ফুটবলারদের নিয়ে গড়া এবারের ব্রাজিল টিমটাকে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণই বলা চলে। নেইমার-জেসুস-উইলিয়ান-কুটিনহো-পাওলিনহো-সিলভা-মার্সেলোদের নিয়ে গড়া এ্যাটাক-মিডফিল্ড-ডিফেন্সে এবার অনেকটাই অপ্রতিরোধ্য তিতের ব্রাজিল। তবে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত পথ মোটামুটি মসৃণ হলেও সেমিতে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতে পারে জার্মানির সাথে। গত বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে ৭-১ বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে নাকি নতুন ইতিহাস লিখবে পাঁঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল তার উপরেই অনেকাংশে নির্ভর করছে দলটির হেক্সা জয়ের সম্ভাবনা।
সবকিছু ঠিকমত এগুলে সেমিফাইনালের লাইন আপ হতে পারে ব্রাজিল-জার্মানি এবং ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা। অনিশ্চয়তার ফুটবল খেলায় যদিও যে কোন কিছুই সম্ভব। অপ্রত্যাশিত কোন ফলাফল যেমন ফুটবলের সৌন্দর্যবৃদ্ধিতে সক্ষম তেমনি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর সম্ভাবনা বিশ্বকাপের সেই শুরু থেকেই সবচেয়ে বেশি বলে প্রমাণিত হয়ে আসছে। তবে নিশ্চিতভাবেই সবকিছুর জবাব পাওয়া যাচ্ছে।

মস্কোর সেই লুঝনিকি স্টেডিয়ামে, আগামী ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই তারিখে। ততদিন পর্যন্ত চলুক “দ্যা গ্রেটেস্ট শো অন দ্যা আর্থ”-এর উত্তেজনাপূর্ণ ক্ষণগণনা আর নির্দোষ সমর্থনে ঝড় উঠুক চায়ের কাপে।