এই পর্বে থাকছে টেস্ট ক্রিকে্টে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান দের সেরা ৫ ইনিংসের আমাদের নির্বাচিত তালিকার দ্বিতীয় অংশ। চলুন তবে দেখে নেওয়া যাক।

#৩ মোহাম্মদ আশরাফুল ১৫৮* বনাম ভারত, চট্রগ্রাম ২০০৪
একটি বিশুদ্ধ রত্ন কিভাবে একটি গুরুতর বিতর্কে পরিণত হতে পারে, মোহাম্মদ আশরাফুল সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সেটা না। সেই কালো অধ্যায়ের পরিবর্তে আজ আমরা টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর সেরা সেরা ইনিংসের দিকে ফোকাস করবো।
আশরাফুল হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিস্ময়কর বালক যিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে শ্রীলঙ্কার বিশ্বমানের বোলিংয়ের আক্রমণের বিপক্ষে বিশ্বরেকর্ড গড়া দুর্দান্ত শতক দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের যাত্রা শুরু করেন। এরপরেও তিনি তার দেশের জন্য অনেক স্মরণীয় ইনিংস খেলেছেন। যদিও, তার ধারাবাহিকতা নিয়ে সবসময়ই কিছু প্রশ্ন ছিল, তবে আপনি যদি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই সময়কার অবস্থা বিবেচনা করেন তবে সেই প্রশ্ন খুব একটা গুরুত্ব রাখে না।
আশরাফুলের ৬ টি টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে আমরা তার সেরা ইনিংস হিসাবে আমরা এই ইনিংটিকে ই বেছে নিয়েছি। চট্রগ্রামের ওই টেস্টের তৃতীয় দিন সকালে আশরাফুল যখন ব্যাট হাতে মাঠে নামেন তখন ভারতের পাহাড় সম ৫৪০ রানের জবাবে বাংলাদেশের সংগ্রহ ৩ উইকেটে ৫৪ রান। এমতবস্থায় সম্পূর্ণ শক্তির ভারতীয় বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে বাংলাদেশের জন্যে বাজে রকমের এক হার অপেক্ষা করছিল। অবশেষে, ঘটেছিলো ঠিক তাই।

কিন্তু আশরাফুল সেদিন ছিলেন ভিন্ন মেজাজে, তিনি শুরু থেকেই ভারতীয় বোলারদের উপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকেন। ভাল বলকেও খারাপ বানিয়ে একের পর এক বাউন্ডারি মারতে থাকেন। অপর প্রান্তে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়তে থাকলেও তিনি নিজের খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস যখন ৩৩৩ রানে শেষ হয়ে যায়, তখন তিনি ১৯৫ বলে ১৫৮ রান করে অপরাজিত। পুরো ইনিংস জুড়ে তিনি ২৪ টি চার ৩ টি ছক্কা হাঁকান।
মাত্র ৭ রানের জন্যে ফলো অনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামে বাংলাদেশ। পরে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং ধ্বসে পড়ে বাংলাদেশ আরো একটি ইনিংস পরাজয়ের বরণ করে।কে জানে? সেদিন অপরপ্রান্ত আশরাফুল যোগ্য একটা সমর্থন পেলে হয়তো ম্যাচের ফলাফল অন্যরকমও হতে পারতো।
#২ আমিনুল ইসলাম ১৪৫ বনাম ভারত, ঢাকা, ২০০০
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য টেস্ট ইনিংসের কথা স্মরণ করেলে, ২০০০ সালে নভেম্বর মাসে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের উদ্বোধনী টেস্ট ম্যাচের আমিনুল ইসলামের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস টি উল্লেখ না করাটা হবে চরম অপরাধ। তিনি হলেন নিজের দেশের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে সেঞ্চুরি করা তৃতীয় ক্রিকেটারের। তাঁর ৩৮০ বলের ১৪৫ রানের ইনিংস মধ্যে ছিল ১৭ টি চার। তাঁর এই ইনিংসের কল্যানেই বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৪০০ রানের স্বপ্নের স্কোর করে।
অবশেষে, দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ মাত্র ৯১ রানে অল আউট হয়ে ৯ উইকেটে পরাজয় বরণ করে। তবে, আমিনুলের এই উজ্জ্বল প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ বাকি ক্রিকেট বিশ্বকে বলতে পেরেছিল যে আমরা সত্যিই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার যোগ্য ছিলাম।

আমিনুল ইসলামের সেই পরিপক্ক ও ধ্রুপদী ইনিংস ধৈর্য ও মেজাজের একটি নিখুঁত উদাহরণ ছিল। আক্ষরিক অর্থেই এটি সবসময় যে কোনো তালিকাতেই উচ্চতর অবস্থান দাবী করে।
#১ শাহরিয়ার নাফীস ১৩৮ বনাম অস্ট্রেলিয়ায়, ফাতুল্লাহ ২০০৬
এটিই আমাদের তালিকার শীর্ষ বাছাইকৃত অসামান্য টেস্ট ইনিংস। প্রকৃতপক্ষে এটিই শাহরিয়ার নাফীসের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরি। আর এটি এখনও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান এর একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরি। মূলত এই বিশেষ ইনিংসটি বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান এর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য টেস্ট ইনিংস হিসাবে বেছে নেওয়ার অনেক কারণ রয়েছে।
এটি হল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচে নস্টালজিক টেস্ট ম্যাচের সবথেকে সাহসী ইনিংস। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত ঘরের মাঠে অসীম শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। আসলে, অস্ট্রেলিয়ার সেই দলটি নিঃসন্দেহে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলের ছিল।
মূলত, সেই ম্যাচে বাংলাদেশের হারানোর কিছুই ছিল না, তাই ম্যাচের শুরু থেকেই বাংলাদেশ ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে খেলতে থাকে। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর হল, শাহরিয়ার নাফিস তার ইনিংস জুড়েই এই ইতিবাচক মানসিকতা ধরে রেখেছিলেন।
আসলে, অস্ট্রেলিয়ার সেই বোলিং আক্রমণটা ছিল কিংবদন্তি ব্রেট লি, শেন ওয়ার্ন, জেসন গিলেস্পি আর সাথে স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল এবং স্টুয়ার্ট ক্লার্কের মত অস্ত্রে সজ্জিত। আর সেই দানবীয় বোলিং আক্রমণকেই নাফিস অবিশ্বাস্য আত্নবিশ্বাস নিয়ে মোকাবেলা করে গিয়েছিলেন আর ক্রিকেটীয় ব্যাকরণ বইয়ের পাতায় এহেন কোন শট নেই যে তিনি খেলেন নি।

পুরো ক্রিকেট বিশ্ব আর সাথে দানবীয় অস্ট্রেলিয়ানরাও ২১ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি ছেলের ব্যাটিং এ সেদিন বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ১৯ চারে ১৮৯ বলে ১৩৮ রানের এক চমৎকার ইনিংস খেলে আউট হন শাহরিয়ার নাফীস।
বাংলাদেশ হয়তো সম্প্রতি টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছে এবং সম্ভবত ভবিষ্যতে আবারো তাদের হারাবে, কিন্তু প্রকৃত দৈত্য বধ করার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আফসোস এদেশের ক্রিকেট প্রেমীদের সবসময়ই থেকে যাবে। আর নাফীসের এই অত্যাশ্চর্য ইনিংস ছাড়া সেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া দলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগটাই হয়তো বাংলাদেশ পেত না। এটাই আপনাকে শাহরিয়ার নাফিসের এই অবিশ্বাস্য সাহসী ইনিংসের অসাধারণত্ব ও মহিমা বুঝতে সাহায্য করবে।