গ্রেট ফুটবলাররা দু’ধরনের হয়- হয় ক্লাব কিংবদন্তি আর নয়তো জাতীয় নায়ক। যারা নামকরা ক্লাব এবং দেশ- উভয় ক্ষেত্রে সমান ভাবে উজ্জ্বল ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান, ডাকনাম “জিজ্জু”।

আলজেরিয়া এবং ফ্রান্স-দু’দেশের দরজাই খোলা ছিল জিদানের জন্যে। একটা গুজব ছিলো- আলজেরিয়ার তৎকালিন কোচ জিদানকে দলে ডাকেন নি কারণ নাকি জিজ্জু কিছুটা ধীরগতির খেলোয়ার ছিলেন। সত্যি বলতে, আগেই ফ্রান্স দলের হয়ে মাঠে নামার কারণে জিদান আর দেশ পরিবর্তন করতে চান নি, যেটা ২০০৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে তিনি পরিষ্কার করেন।
দশ বছর বয়সেই ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৭২ সালে ফ্রান্সের মার্সেইতে জন্মানো আলজেরিয়ান বংশদ্ভূত জিদানের। তবে বিশ্বজুড়ে প্রচারে সামনে আসেন ১৯৯৬ সালে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে জুভেন্টাসের মত ক্লাবে যোগদানের মাধ্যমে। সেখানে পাঁচ বছর এবং পরবর্তী পাঁচ বছর রিয়াল মাদ্রিদে-এই দশ বছরে জিদান লীগ শিরোপা, চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ ট্রফি, ব্যালন ডি’অর-সহ সম্ভাব্য সবকিছু জিতেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় ফুটবল সমর্থকদের একনিষ্ঠ সমর্থন এবং হৃদয় জয় করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন জিজ্জু অত্যন্ত সফলভাবেই।

জিদান একজন স্কোরার ছিলেন না, ছিলেন সম্পূর্ণ একজন প্লেমেকার। ৫০৬ টি ক্লাব ম্যাচে ৯৬ গোল- তাঁর গোল করার দক্ষতা বর্ণনা করতে যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনের সময় সবচেয়ে মূল্যবান এবং ইতিহাস সৃষ্টি করা কিছু গোলের সাক্ষী জিদানের সাফল্যের শোকেস। ২০০২ সালে বেয়ার লিভারকুসেনের বিরুদ্ধে জিনেদিনের দুর্বল বাম পায়েরই শক্তিশালী ভলি থেকে করা এযাবৎ চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেরা গোলটি এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
জিদানের সেরা দিকটি হচ্ছে তাঁর জাতীয় দলে পারফর্ম করার ক্ষমতা। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সের অনূর্দ্ধ-১৭, অনূর্দ্ধ-১৮ এবং অনূর্দ্ধ-২১ দলের পক্ষে খেলেছেন। ১৯৯৬ সালে ফ্রান্সের জাতীয় দল তাঁর সুযোগ পাওয়ার পরেই ফ্রান্সের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হয়। ঘরের মাঠে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে আক্ষরিক অর্থেই জিদান এ্যান্ড কোং সেসময়ের সর্বজয়ী ব্রাজিলকে গুড়িয়ে দেয়, যে বিশ্বকাপে ফ্রান্সের সেনাপতি ছিলেন ওই জিদান। দুই বছর বাদে ২০০০’র ইউরোও ফ্রান্সের ঘরে আসে জিদানের পায়ে ভর করে।

২০০২-র বিশ্বকাপ ছিলো ফরাসীদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। ইনজুরড জিদানের অভাবে ফ্রান্স সেবার গ্রুপ পর্বের গন্ডিই পার হতে পারে নি। এমনি গ্রীসের মত আন্ডার-ডগ টিমের কাছে ফাইনালে হেরে তাদের খোয়াতে হয় ২০০৪ সালের ইউরো শিরোপাও। এ সময় প্রথমবারের মত অবসরের ঘোষণা দেন জিজ্জু।
ম্যকলেলে, লিলিয়ান থুরাম, সাথে জিদানের মত অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের গণ-অবসরের ফলে ফ্রান্স ২০০৬ বিশ্বকাপের কোয়ালিফিকেশন থেকেই থেকে ছিটকে পরার জোগাড় হয়েছিলো। জিদানকেই এ অবস্থায় ফিরে আসতে হতো। শেষ মুহূর্তে দেশের প্রয়োজনে জিদান শেষবারের মত জাতীয় দলে ফিরলেন এবং জন্ম দিলেন শতাব্দীরই অন্যতম বড় ট্রাজেডিটার।
ফ্রান্সের সামনে দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ ছিলো। চিত্রকল্প লেখা ছিলো, মঞ্চ প্রস্তুত ছিলো এবং পরিবেশও ছিলো অনুকূলে। কিন্তু সেখানে সেনাপতি এক মারাত্মক ভুল করে বসেন। ফাইনালের অন্তিম মুহূর্তে মাথা গরম করে মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুঁশ মারার পরিণতিতে জিদানের লাল কার্ড প্রাপ্তিই সেই ফাইনালের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। ফ্রান্সকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হয় শিরোপা হারিয়ে। ইতালির কাছে পেনাল্টি শুট আউটে ৫-৩ গোলে হারে ফ্রান্স।
২০০৬-র বিশ্বকাপের পরেই জাতীয় দলের বুট জোড়া খুলে রাখেন জিদান। মাতেরাজ্জি ঘটনার পরে ফিফার শাস্তি মোতাবেক তিন ম্যাচের বহিষ্কারাদেশ জিদান পূর্ণ করেন ফিফার শিশুবিষয়ক প্রকল্পে তিনদিন বিভিন্ন কর্মসূচি করে।
অবসরের পর জিনেদিন জিদানের কোচিং ক্যারিয়ার তাঁর খেলোয়ার জীবনের মতই সমান ঔজ্জ্বল্যের স্বাক্ষর রেখে চলছে। ২০১৪ সাল থেকে রিয়াল মাদ্রিদে পূর্ণাঙ্গ কোচ হিসাবে যোগদান করার পর থেকে এরই মধ্যে টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা জয় সেটাই প্রমাণ করে। বিশেষ করে মনে রাখা জরুরী, জিদানের বয়স মাত্র ৪৬ চলছে। সামনে তার কোচিং ক্যারিয়ারের স্বর্ণযুগ পরে আছে বলেই ধারণা করা যায়।

খেলোয়াড় হিসাবে জিজ্জু ইউরো, বিশ্বকাপ, ব্যালন ডি’অর, গোল্ডেন বল জয়ী ক্ষণজন্মা কিছু ফুটবলারদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তবে তাঁর ক্যারিয়ারে কালো দাগ হয়ে থাকবে ১৪ টি লাল কার্ড। জিদানের নিজের বক্তব্য মতে, “ক্যারিয়ারের চৌদ্দটি লাল কার্ডের মধ্যে বারোটাই ছিল উস্কানির ফলাফল। এটা যুক্তিযুক্ত নয় এবং এটি অজুহাতও নয়; কিন্তু আমার আবেগ, মেজাজ এবং রক্ত আমাকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য করেছে”। আর এজন্যই অবিশ্বাস্য দক্ষতা, সামর্থ্য আর সাফল্যের পরেও জিনেদিন জিদান একজন রক্তমাংসের মানুষ।